স্কুল ছাড়ার ২৫ বছর পর স্মৃতিকথা লিখতে বসে কত কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে।সেই কেজি ওয়ান থেকে ক্লাস টেন-১২ বছরে স্কুলবাড়িটা যেন কেমন নিজের বাড়ির মতোই হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম যেদিন
Admission test দিতে গিয়েছিলাম সেদিনকার অভিজ্ঞতাটাই বলি প্রথমে।খুঁটিনাটি সমস্ত মনে
নেই যদিও তবুও মূল ঘটনাটা মায়ের কাছ থেকে শোনা।গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকের ছোটো একতলার
ঘরটা তখন কচিকাঁচায় প্রায় ভর্তি।একজন বা দুজন সিস্টার আর দিদি ছিলেন।নানান কিছু রঙিন
খেলনা,ব্লক ইত্যাদি দেখিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছিল,অনেকেই খুব কাঁদছিল আমি আবার তাদের কান্না
থেকে বিরত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারছিলাম না ওরা কেন অত কাঁদছে!এদিকে মা
তো আমাকে বলে রেখেছে যে সব প্রশ্নের উত্তর
দিতে পারলেই সিস্টার আমায় একটা বড় পুতুল আর চকোলেট দেবেন।আমি তো সেই আনন্দেই নাচছি।যাই
হোক প্রশ্ন পর্ব শেষ হতেই তৎক্ষণাৎ আমার গিফটের দাবি করে বসলাম সিস্টারের কাছে-
"কই দাও আমার পুতুল আর চকোলেট,মা যে বললেন সব পারলে দেবে।"ওইটুকু একটা ছোট্ট
শিশুর মুখে এমন কথা শুনে সিস্টারও বোধহয় একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আর তাই হয়ত কোলে করে
আমাকে বাইরে মায়ের কাছে দেবার সময় হাসতে হাসতে বললেন-"তোমার মা ই কিনে দেবেন তোমায় তুমি যা চাও"আর মাকে অনুরোধ
করলেন আমাকে যেন কিনে দেওয়া হয়। তখন আর ওখানে পুতুলের দোকান কোথায়!যাইহোক,সেদিনকার
মতো আমাকে চকোলেট আর আইসক্রীম দিয়েই শান্ত করা হয়েছিল।তারপর থেকে শুরু হয়ে গেল স্কুল
জীবন।খুব ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে থাকতেই স্কুলবাস চলে আসত পূর্বাশায়।হৈ চৈ করতে করতে যখন স্কুল পৌঁছাতাম দেখতাম সকাল হয়ে গেছে আর স্কুলের
কাছাকাছি আসতেই আমাদের সমবেত কলরব- "লাল বাড়ি এসে গেছে,লাল বাড়ি এসে গেছে".....হ্যাঁ স্কুলের বাইরেটা তখন লাল রঙেই রাঙানো ছিল।মনে পড়লে
হাসি পায় এখনও-মাকে বলতাম "মা রাত্রিবেলা এলাম আর সকাল হয়ে গেল!" অবশ্যই
বাড়ি ফিরতে বলা বাহুল্য।কে.জি.সেকশন এ বন্দনাদি আর আরতিদি ছিলেন।অনেক স্নেহ-ভালবাসা
পেয়েছি ওনাদের কাছে।মনে আছে আরতিদি এসেই পুরো ক্লাসকে হেড ডাউন করে আমাকে কাছে ডেকে
বলতেন গান গাইতে-ওই যে ওই গানটা-"কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল /
কোন দেশেতে চলতে গেলে দলতে হয়রে দূর্ব্বা কোমল"....কে.জি.টুতে
অঙকের টিচার রমলাদিকে খুব ভয় পেতাম।আর আমাদের প্রাইমারি সেকশনের হেডমিস্ট্রেস সিস্টার
অ্যাঞ্জেলা -উনি তো ঠিক ছিলেন আমাদের মায়ের মতো।অপরিসীম মাতৃস্নেহে ভরিয়ে রাখতেন।কী
শান্ত,মিষ্টি স্বভাব।ধৈর্যশীলা অথচ বিপরীত পরিস্থিতে কঠোর হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ
করতেন না।কত কথাই যে মনে পড়ছে আজ লিখতে বসে।যখন খুব অসুস্থ হতাম মা স্কুলে ওষুধ দিয়ে
যেত সিস্টারের হাতে পরীক্ষা দিতে দিতে ডাক পাঠাতেন সিস্টার ,পরম যত্নে খাইয়ে দিতেন
ওষুধ।
এরপর
দেখতে দেখতে প্রাইমারির গন্ডী পার হয়ে পা রাখলাম সেকেন্ডারিতে।দিদিদের কাছে যেমন আদর
পেয়েছি তেমনি দুষ্টুমি করলে শাস্তিও পেয়েছি সমানভাবে।তখন হয়তো অনেক রাগ করেছি , ভুল
বুঝেছি তাদের।কিন্তু পরে বুঝেছি যে সেই শাসনগুলোর কতো প্রয়োজন ছিল এই জীবনে।হয়ত তাই
আজ এইভাবে নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি।সিস্টার রোমানা কঠোর শৃঙ্খলায় বেঁধে
দিয়েছিলেন আমাদের।আর চ্যাপেল ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।যেভাবে প্রার্থনা,গান ইত্যাদি
শেখানো হতো তাতে মনে হতো নিজেদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভাকে আমরা কখনোই আবিষ্কার করতে পারতাম
না যদি না দিদিরা আর সিস্টাররা ওইভাবে আমাদের গাইড করতেন।আজ এত বছর পরে স্কুল জীবনের
সেই দিনগুলোকে খুব মিস করি।প্রতিদিন প্রেয়ার প্রোগামের মধ্য দিয়ে দিন শুরু হতো।তারপর
কতকিছু চলত সারাদিন ধরে ।Christmas এ খুব সুন্দর করে সাজানো হত।আমরা হাতের কাজের ক্লাসে
যেসব জিনিস বানাতাম তাই দিয়ে Exhibitin cum sale হত।এছাড়া ফুড স্টল হত।আমরা বাড়ি থেকে
আলু, পেয়াঁজ ইত্যাদি নিয়ে যেতাম আর সেগুলোকেএকত্র করে বিশাল রান্নার আয়োজন হত।মিরর
রুমে সব কাঁচামাল জড়ো করা হত।তারপর চলত আয়োজন- একেবারে হৈ-চৈ পড়ে যেত যেন।মেন গেটের বিপরীতে যে গেটটা ছিল তার পেছনে অন্ধকার মত বিশাল
করিডোরটায় রান্না হত।আবার অনেকে বাড়ি থেকেও কিছু রান্না করে আনত সেগুলোকে এক জায়গা
করে বিক্রি হতো।বাড়ির লোকেরাও আসত এই অনুষ্ঠানে।তারাও
আমাদের জিনিষ কিনতেন।দিদিদের মধ্যে যাদের পরম বন্ধুর মতো পাশে পেয়েছি তারা হলেন বন্দনাদি,আরতিদি,কণাদি,শর্মিষ্ঠাদি,ছোটতৃপ্তিদি,আল্পনাদি,জয়ন্তীদি,লতিকাদি,শাশ্বতীদি,নন্দিনীদি,নীলিমাদি,নীতিকাদি,সুচিত্রাদি,দেবিকাদি,অঞ্জলিদি,আর সিস্টারদের মধ্যে
সিস্টার রোমানা, সিস্টার মেরি যোশেফ,সিস্টার লিলিয়ান,সিস্টার মনিকা প্রমুখ ।শাসনে
-সোহাগে এরা আমাদের বড়ো করে তুলেছিলেন একটু একটু করে।
স্কুলজীবনের
গন্ডী পেরোনোর অনেক বছর পর যখন আবার সেই একই
স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে প্রবেশ করেছি ,তখনকার অভিজ্ঞতা ভিন্ন স্বাদের ,ভিন্ন মাত্রার।নিজেকে
ধন্য মনে হত যে যাদের হাতে বড় হয়ে উঠেছি, তাদের সাথেই আবার এক জায়গায় মিলিত হতে পেরেছি
যা কিছু শিখেছি ,জেনেছি তার মূল ভিত্তিভূমি
যে আমার স্কুল ,আমার শিক্ষিকারা। এ জীবনে তাদের ঋণ শোধ করতে পারব না হয়ত। দিদিদের মধ্যে
অনেককেই হারিয়েছি আজ,বন্ধুদের মধ্যেও কয়েকজনকে।তবুও
স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে পিছনে ফেলে আসা ওই দিনগুলো।
No comments:
Post a Comment