প্রিয় বন্ধুরা,
হেদুয়ার পাশ ধরে, বসন্ত কেবিনের গা ঘেঁষে যে রাস্তাটা চলে গেছে, আমার বেওয়ারিশ ছোটবেলাটা সেই রাস্তায় এখনো গুটিগুটি ঘোরাফেরা করে৷ অনেকটা সোজা চলে যাবার পর রাস্তার ওই পারে আসে একটা বিশাল গাড়িবারান্দা, পুরো ফুটপাথটা ঢেকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছায়া করে রাখে সেটা; আর এই পারে আসে একটা ছাই-ছাই রঙের বড় উঁচু গেট। সময়টা বিকেল চারটে মত হলে ওই গেটের পাশে ঠেলা নিয়ে বসে ধবধবে সাদা চুল, সাদা আর ঝোলা গোঁফের হজমিদাদু। হজমি, কারেন্ট নুন, আমচুর, কুলের আচার এইসব স্বর্গীয় জিনিস নিয়ে।
মানে, বসত।
গেট দিয়ে ঢুকে গেলেই বারো বছরের কড়া ডিসিপ্লিনের, বেয়াড়া সব দুষ্টুমির, অসম্ভব মমতাময়ী দিদি আর সিস্টারদের স্নেহের ফল্গুধারার, এত বছরেও অম্লান থাকে এমন বন্ধুদের হাসির ঘরবসত। সে এক আজব ডিজাইনের বাড়ি, তাতে যত দরজা তত সিঁড়ি। কাঠের বাহারী নকশাকাটা লাইব্রেরির সিঁড়ি, গেটের পাশ দিয়েই ধাঁইধাপ্পা সোজা সটাং উঠে যাওয়া বেজায় সরু সিঁড়ি যাতে পাশাপাশি দুজন উঠলে দেওয়ালে কনুই ঘষে যেতেই পারে, ফাংশনের হলের ভিতরে অ্যান্টিরুমের সিঁড়ি যার কোন এক তলার নিচের জায়গায় - আরে যেমন জায়গায় হ্যারি পটার থাকত গো - ক্লাসে কথা বলে শাস্তি পেয়ে বার করে দেওয়া ফ্রক পরা নাকটানা বাচ্চা দুটো, এখনো চুপি চুপি বর-বৌ সেজে খেলে।
তো, এই কোনো একটা সিঁড়ির বাঁকে, খুব সম্ভবত ওই দারোয়ানজীর টুলের পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া স্বর্গের সিঁড়ির একটা বাঁকে একটা ছবি ঝুলত। মানে, ছবি বিস্তর ঝুলত সে বাড়িতে, কোথাও মায়াবী নীল পোশাকে দুহাত জড়ো করা মাতা মারিয়া - সে চোখের দৃষ্টি দেখলে আমার খালি সেই জেড পাথরের মেয়ে মূর্তির কথা মনে হত যে আনত চোখেও বুকের একদম ভিতর অবধি দেখে ফেলতে পারে; কোথাও ধূসর সেন্ট বার্থালোমিয়ার পেইন্টিং, গূঢ় বিষণ্ণ হাসি চোখের কোণে, যাঁর ফোটো ডায়েরির পাতায় থাকত। এরকম আরো কত৷
এই ছবিটা ছিল সিঁড়ির মোড় ঘোরার জন্য ছেড়ে রাখা ছোট্ট চাতালটার দেওয়ালে৷ যদ্দূর মনে পড়ছে উঁচুতে থাকা দুটো লম্বাটে সবুজ কাঠের জানলার মাঝে। ছবিটা খুব সহজ, দেখা যাচ্ছে একটা আয়নার সামনে একটা মোমবাতি জ্বলছে, আয়নায় তার ছায়া পড়ছে।
সেই সঙ্গে একটা লাইন লেখা ছিল উপরে। আজ ভুলে গেছি কেমন ছিল সে আয়না, গোল না চৌকো, কাঠের ফ্রেম না ধাতুর, কেমন ছিল মোমবাতিদানটা, শিখাটা বাঁদিকে বেঁকে না ডানদিকে। এমনকি ছবির রঙ পর্যন্ত মুছে গেছে মন থেকে। কিন্তু কথাটা বুকের কুঠুরির দেওয়ালে খোদাই হয়ে রয়ে গেছে।
"There are only two ways of spreading light - either be the candle, or be the mirror that reflects it."
হোলি চাইল্ড ইন্সটিটিউট এক অনির্বাণ শিখার মত চিরকাল আমাদের পথে আলো দেখিয়েছে। এরকম অজস্র শিক্ষা, সোচ্চারে যত তার চেয়ে অনেক বেশি নীরবে, প্রতিদিনের ডিসিপ্লিনের মাধ্যমে, দিদি-সিস্টারদের নিজেদের আচরণে, শাসনে, উদাহরণে, স্নেহে, আমাদের প্রত্যেকের কোষে কোষে মিশে গেছে। আমাদের গড়ে ওঠাটুকু হোলি চাইল্ডে, এ কথা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারব না।
আমাদের মেয়েবেলাগুলো আজও, এখনো সেই ঝুঁটি বিনুনি ফিতে বেঁধে সারি দিয়ে দাঁড়ায় নিম আর সবেদার পাহারা দেওয়া উঠোনে, তদের সম্মিলিত গলার স্বরে গমগম বেজে ওঠে “প্রভাতের তারা মাতা মারিয়া”, এখনো কনুই ধাক্কা খেয়ে যাবে এমন ডেস্কে বসে ফাঁকা ক্লাসে হি হি হাসি হাসে আর পিনড্রপ সাইলেন্সে বিপরীতার্থক শব্দ লেখে, এ(খনো মিরর রুমের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় টুক করে সেই বেলজিয়ান কাচের আয়নায় একবার মুখটা উঁকি দিয়ে দেখে নেয়।
সেই সোনালী দিনগুলোর এক ঝলক, সেই মেয়েদের আজ আবার হাতে হাত রাখার শপথ নিয়ে গড়া এই অনলাইন ম্যাগাজিন “মিরর রুম”।
অবারিত দ্বার এই “মিরর রুম”এ সবাইকে স্বাগতম!
- অনুষ্টুপ শেঠ
(সঙ্গের ছবিটি মনশ্রী পয়রার আঁকা।)
No comments:
Post a Comment