Wednesday, November 14, 2018

মন থেকে - নমিতা পোদ্দার (মানালির মা)


আমি মানালির মা।আমাকে বলা হলো হোলি চাইল্ড সম্বন্ধে কিছু বলতে।হোলি চাইল্ড এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহুদিনের।মানালির সাথে ১০+=১২ বছর - তারপর মানালির বোন জিনিয়ার সাথে আবার ১০ বছর।যে বছর মানালি মাধ্যমিক দিলো জিনিয়া তখন ক্লাস ওয়ান।তাই অনেক স্মৃতি আছে হোলি চাইল্ডকে জড়িয়ে।


আমরা
যখন পাইকপাড়াতে আসি তখন মানালির বয়স বছর।এখানে এসে আমরা  প্রতিবেশী হিসাবে পেলাম ইরিনাদের পরিবারকে ইরিনাদের বাবা মা আমাদের বন্ধু হলো আর মউ ( মানালি আগে মউ ছিলো ) আর ইরিনা হলো প্রাণের বন্ধু। খেলাধূলা খাওয়া-দাওয়া  এমনকি ওরা একসাথে ঘুমাতোও মাঝেমাঝে। তো এইভাবে মেয়েগুলো বড় হতে লাগলো। এবার স্কুলে ভর্তি করার পালা। ইরিনার বাবা  খবর নিয়ে এলেন হোলি চাইল্ড ইনস্টিটিউট এর। বললেন মিশনারি স্কুল কিন্তু বাংলা মিডিয়াম। সিস্টাররা সব বাংলাতেই কথা বলেন। অসুবিধা হবে না। ফর্ম তোলা হলো। ইন্টারভিউ হলো। বড়  দরোয়ান বললো বাড়ীতে চিঠি যাবে।
কিছুদিন পর বাড়ীতে চিঠি  এল আর মেয়ে স্কুলে ভর্তি হলো, কে জি ওয়ানে।
সেই সঙ্গে শুরু হলো হোলি চাইল্ডের হাত ধরে পথ চলা।


আমার মেয়েতো প্রথম দিন থেকেই স্কুলকে ভালোবেসে ফেলেছিল।
একটা দিনের জন্যও কান্নাকাটি করেনি। ইরিনা অবশ্য প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করতো, তারপর সে-ও স্কুলকে ভালবেসে আপন করে নিল।


মেয়েদের
মায়েদের মধ্যেও সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। একজন বাবা কিংবা মা অন্যের মেয়েদেরও খেয়াল রাখতেন। আমার মনে আছে, স্কুল ছুটির সময় গেটের বাইরে একটা লোক হজমি,আচার,ছোটো ছোটো লাল কুল.....এইসব নিয়ে বসতো। মউ রোজ ওইসব খাওয়ার জন্য বায়না করতো।শর্মির মা আমাকে বলতো ....ওরে ওসব দিসনি, ওগুলো বিষ, খেলে শরীর খারাপ করবে......এরকম কতজনের স্নেহের স্মৃতি রয়ে গেছে।


মনে আছে....ইন্দিরা গান্ধী যেদিন মারা গেলেন .....ওরা তখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ে। দুপুরবেলা সমস্ত স্কুল, কলেজ, অফিস হঠাৎ ছুটি হয়ে গেলো। আমি আর ইরিনার মা  হেঁটেহেঁটে স্কুল পৌঁছালাম। স্কুলে পৌঁছে দেখি মউ এর বাবাও অফিস  থেকে চলে এসেছেন। কিন্তু......এইবারে দেখি কি... আমাদের মেয়েরা মানে মউ আর ইরিনা সেখানে নেই। ওদের আর খুঁজে পাইনা.....শেষে একজন গার্জেন বললেন.....একজন ভদ্রলোক তাঁর নিজের মেয়ে আর আমাদের মেয়েদুটোকে একটা রিক্সায় চাপিয়ে নিয়ে চলে গেছেন।এইবার ওই গন্ডগোলের মধ্যে আমরাতো বুঝতেই পারছিনা কে নিয়ে গেলো আমাদের মেয়েদুটোকে !!! তখন তো আর মোবাইলফোন  ছিলো না। নানারকম চিন্তা করতে করতে হেঁটেহেঁটে বাড়ী পৌঁছালাম। ফিরে দেখি ইরিনাদের বাড়ীতে শর্মির বাবা  বসে আছেন।উনি অনেক কষ্টে একটা রিক্সা ঠিক করে তাতে তিনটে মেয়েকে বসিয়ে নিজে হেঁটে এসেছেন। আজ অবাক হয়ে ভাবি , বাচ্চাগুলোর প্রতি কতটা ভালোবাসা , দায়িত্ববোধ এবং সাহস থাকলে এই কাজ করা যায়।


স্কুলের ডিসিপ্লিন ছিলো খুব কঠোর। নানা নিয়মের মধ্যে মাথায় সাদা ফিতে বাঁধা ছিলো জরুরি। একবার একটি মেয়ে ন্যাড়া হলো। নামটা মনে পড়ছে না.....কালিন্দী থেকে আসত। প্রথম দিন ফিতে বাঁধেনি । কিন্তু তারপরের দিন থেকে বেচারাকে ন্যাড়া মাথাতেই ফিতে বেঁধে আসতে হয়েছিল।


হোলি চাইল্ডের যেসব মেয়েরা লেখাপড়ায় ভালো ছিল, বছরের শেষে রেজাল্ট এর দিন, যে যে বিষয়ে ভালো করত তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হতো। এমনকি যার অ্যাটেন্ডেনস সবচেয়ে বেশি হতো তাকেও সার্টিফিকেট দেওয়া হতো। রাখী মুখার্জী আমাদের পাড়াতেই থাকতো।প্রায় প্রত্যেক বছর রাখী ওই অ্যাটেন্ডেনস সার্টিফিকেটটা নিশ্চয়ই পেতো। একবার ভরা বর্ষাকাল। কদিন ধরেই খুব বৃষ্টি হচ্ছে।  বাড়ির সামনে রাস্তায় এক হাঁটু জল  জমে গেছে। সেই সময় বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিও হতো আর বৃষ্টি হলেই রাস্তায় জলও জমতো। আমরা বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি,জমে থাকা জলও দেখছি। মানালি কাগজের নৌকো বানিয়ে খেলছে......সকাল ১০:৩০-১১:০০টা হবে.....দেখি কি রাখী আর রাখীর মা এক হাঁটু জল ভেঙে আসছে। রাখীর পরনে স্কুল ড্রেস। জিজ্ঞাসা করলাম......কি ব্যাপার।বলল......স্কুলে গেছিলাম ,স্কুল বন্ধ, রেনি ডে........তার স্কুল যাওয়ার নিষ্ঠা দেখে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম।

 
হোলি চাইল্ডে সব সিস্টার , টিচাররাই খুব ভালো ছিলেন। মনে আছে .....প্রাইমারিতে তখন  সিস্টার অ্যাঞ্জেলা ছিলেন। উনি তো  আমার মেয়েকে মউ মাদার বলে ডাকতেন আদর করে। মানালি তখন মউ ছিলো। একবার মানালি বেড়াতে গিয়ে এত ভালো লেগেছিল যে আমি মেয়ের নামই বদলে দিয়েছিলাম।
তখন হোলি চাইল্ড এর হেডমিস্ট্রেস ছিলেন সিস্টার রোমানা। উনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন,কিন্তু ওঁকে ভয় পেতোনা এমন মেয়ে স্কুলে একটিও ছিলোনা। সিস্টার রোমানার অফিসকে মেয়েরা বলতো বাঘের গুহা। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখেছি মেয়েরা নিজের পার্সোনাল প্রবলেমও গিয়ে ওঁর সাথে শেয়ার করত। উনি খুব ভালো ভাবে গাইডও করতেন। তারপর সিস্টার রোমানা দিল্লী চলে গেলেন। পরে আমরা একবার দিল্লী  গিয়েছিলাম। মানালি ওর বাবার সঙ্গে গিয়ে সিস্টারের সঙ্গে দেখা করে এসেছিল। এরকম প্রচুর ঘটনা ,অনেক স্মৃতি....... সব তো আর লেখা যাবে না। আমার মনে সযত্নে রক্ষিত থাক। ভাবতেই অবাক লাগছে এর মধ্যেই ২৫টা বছর ঘুরে গেছে তোমাদের  মাধ্যমিক দেবার পর....!!!


হোলি চাইল্ডের ‘৯৩ ব্যাচ রজত জয়ন্তী উৎযাপন করছে । খুবই আনন্দের কথা।মানালি আমাকে বলল এই উপলক্ষে আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে চায়। আমি মজা করে বলেছিলাম .....বদলে কি পাবো? আমার কিছুই চাইনা। শুধু চাই আমার সব মেয়েরা,যে যেখানে আছে ,সবাই যেন সুখে শান্তিতে সুস্থ থাকে। অনেক বড় হোক,জীবনে সফল হোক। আমার অনেক ভালোবাসা, অভিনন্দন এবং আশীর্বাদ রইল সবার জন্য।






No comments:

Post a Comment

স্বাগতম্

প্রিয় বন্ধুরা, হেদুয়ার   পাশ   ধরে ,  বসন্ত   কেবিনের   গা   ঘেঁষে   যে   রাস্তাটা   চলে   গেছে ,  আমার   বেওয়ারিশ   ছোটবেলাটা   সে...