১নং অভেদানন্দ রোডের লাল বাড়ীটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় যখন আমার বয়স ২ বছর।মায়ের সাথে মাঝে মাঝে দিদিভাইকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার ফাঁকে দেখতাম বড়ো বাড়িটা আর সেখানকার মানুষজনকে।সিস্টারদের সদা হাস্যময় মুখ,কোলের কাছে টেনে নিয়ে দু-চারটে বলা কথা ছুঁয়ে গেছিল কচি মনটাকে।তখন জানতাম না ওই লাল বাড়ির মাঝেই গড়ে উঠবে আমার জীবনের ভিত।
অবশেষে
সেই দিনটি এলো।দাদু দিদার হাত ধরে সুটকেস আর ওটল বটল (ওয়াটার বটল) গলায় ঝুলিয়ে গিয়ে
দাঁড়ালাম স্কুল গেটের সামনে।ওমা!একি!!!দাদু দিদা তো আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।ফেরৎ নিয়ে
যাচ্ছেন না তাদের সাথে ।যে বাড়ীটা দেখতে এতদিন এতো ভালো লাগতো .... এক মুহুর্তে বাড়ীটা
আমার কাছে জেলখানা হয়ে গেলো।একটুও ভালো লাগতোনা দাদু,দিদা,বাবা,মায়ের,আমায় এইরকমভাবে
জেলখানায় ছেড়ে দিয়ে যাওয়াকে।শুধু তাই নয় আমার ছুটি হলে আমাকে বাড়ী নিয়ে যাওয়ার সময়
দিদিভাইকে ছেড়ে দিয়ে যাওয়া হতো স্কুলে।অথচ ও আমার মতো কাঁদত না, হাসতে হাসতে বন্ধুদের
সাথে চলে যেত।ছোটো মাথায় গুলিয়ে যেত সব কিছু।স্কুলে থাকলেও মন পরে থাকত বাড়ীতে।
কে জি ওয়ান (ক্লাস টিচার কে ছিলেন মনে নেই)।জীবনের প্রথম কারাগার আমার কাছে।সারা বছর তিনটে শব্দ লিখেছিলাম খাতা ভরে।"হলল" "বলল" "খলল"।রেজাল্ট এর সময় সিস্টার মাকে ডেকে বলেছিলেন মিসেস রায়..."কি করব পরমাকে নিয়ে?ওরাল পরীক্ষায় সব বিষয়ে ভালো নম্বর কিন্তু লেখা পরীক্ষার অবস্থা শোচনীয়।পরমা কিছুই জানে না”। (সিস্টারদের সাথে মায়ের এক অদ্ভুত কেমিস্ট্রি ছিলো,যা স্কুল পরবর্তী জীবনেও দেখেছি)মা বলেছিলেন, "আপনারা যা ভালো বোঝেন তাই করুন"।রেখে দেওয়া হলো আমাকে আবার একই ক্লাসে।বুঝলাম নিস্তার নেই।
আবার কেজি ওয়ান।ক্লাস টিচার আইরিনদি।অদ্ভুত লাগতো মানুষটিকে আমার।লালবাজার থেকে ট্রামে করে স্কুলে আসার সময় অনেক দিন ওনার কোলে বসে হেঁদুয়া অবধি এসেছি।ঘুমিয়ে পরতাম মাঝে মাঝে ওনার কোলে।অথচ ক্লাসে এলে কী রাশভারী ব্যবহার।ভয় পেতাম তখন।কিন্তু পড়াশুনার অবস্থা একইরকম।ভালো লাগতো না।বুঝতাম না কিছুই।(পরবর্তীকালে শিক্ষাজগতে আসার পর বুঝছিলাম আমি ডিস্লেকসিয়াতে আক্রান্ত ছিলাম।)যার ফলে পড়াশুনার ব্যাপারে সব সময় পিছিয়ে থাকতাম।
কে জি ওয়ান (ক্লাস টিচার কে ছিলেন মনে নেই)।জীবনের প্রথম কারাগার আমার কাছে।সারা বছর তিনটে শব্দ লিখেছিলাম খাতা ভরে।"হলল" "বলল" "খলল"।রেজাল্ট এর সময় সিস্টার মাকে ডেকে বলেছিলেন মিসেস রায়..."কি করব পরমাকে নিয়ে?ওরাল পরীক্ষায় সব বিষয়ে ভালো নম্বর কিন্তু লেখা পরীক্ষার অবস্থা শোচনীয়।পরমা কিছুই জানে না”। (সিস্টারদের সাথে মায়ের এক অদ্ভুত কেমিস্ট্রি ছিলো,যা স্কুল পরবর্তী জীবনেও দেখেছি)মা বলেছিলেন, "আপনারা যা ভালো বোঝেন তাই করুন"।রেখে দেওয়া হলো আমাকে আবার একই ক্লাসে।বুঝলাম নিস্তার নেই।
আবার কেজি ওয়ান।ক্লাস টিচার আইরিনদি।অদ্ভুত লাগতো মানুষটিকে আমার।লালবাজার থেকে ট্রামে করে স্কুলে আসার সময় অনেক দিন ওনার কোলে বসে হেঁদুয়া অবধি এসেছি।ঘুমিয়ে পরতাম মাঝে মাঝে ওনার কোলে।অথচ ক্লাসে এলে কী রাশভারী ব্যবহার।ভয় পেতাম তখন।কিন্তু পড়াশুনার অবস্থা একইরকম।ভালো লাগতো না।বুঝতাম না কিছুই।(পরবর্তীকালে শিক্ষাজগতে আসার পর বুঝছিলাম আমি ডিস্লেকসিয়াতে আক্রান্ত ছিলাম।)যার ফলে পড়াশুনার ব্যাপারে সব সময় পিছিয়ে থাকতাম।
একবার কোনো রকমে বাথরুমে যাব বলে
ক্লাস থেকে বেড়িয়ে বড়ো দারোয়ানজী অরুনদার কাছে গিয়ে ঝুলোঝুলি করছি "তুমি ঘন্টা দিয়ে দাও, সিস্টার বলেছেন তোমাকে ঘন্টা দিয়ে দাও"।( এই ঘটনা আবার শুনেছিলাম প্রথম যখন শিক্ষকতার কাজে হোলি চাইল্ডে যোগ দিলাম,তখন দারোয়ানজী মাকে বলেছিলেন, "এই সেই পরমা!!!ঘন্টা দিয়ে দিতে বলেছিল।এখন এই স্কুলের দিদিমনি") ।হঠাৎ কানে টান পরল।দেখলাম সিস্টার ওয়েলমা।আমাকে আলাদা নিয়ে গিয়ে বললেন,"কেন তুমি পড়াশুনা করতে চাওনা"?আমি বলেছিলাম, "সিস্টার আমি তোমার ঘর মুছে দেব,বাসন মেজে দেব।কিন্তু পড়াশুনা করব না"।ফল আবার গার্জেন কল্।(পরবর্তীকালে পুরীতে সিস্টার ওয়েলমার সাথে দেখা
করতে গিয়ে তাঁর হাতের তৈরী লাল সরবৎ খেতে খেতে সেই সব পুরানো দিনের কথা উঠতে সিস্টার বলেছিলেন,"এখনো কী ঘর মুছতে চাও"?)এখন অবাক লাগে ভাবলে, কত ছোটো ছোটো ঘটনা ওনারা মনে রেখেছেন।আর আমরা কত সহজে ভুলে যাই সবকিছু।
দেখতে দেখতে প্রাইমারিতে এলাম।পারুলদি , রাজলক্ষীদি ,জ্যোতিদি,মন্দিরাদি, নীতাদি, মারিয়াদি, কৃষ্ঞাদি, ইন্দ্রানিদি ,সুচিত্রাদি, শিখাদি সবাইকে কাছ থেকে দেখলাম।পড়াশুনার সাথে ভালোবাসা কিন্তু এখনো তৈরী হলো না।তাই বলেএনাদের অপার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হইনি কখনো।যমের মতো ভয় পেতাম রাজলক্ষীদি ও মন্দিরাদিকে।পরে বুঝেছিলাম ভয়টা অঙ্কে ছিলো,ওনাদের প্রতি নয়।
আমার ছেলেবেলায় আমার শিক্ষিকাদের একটা অন্য জায়গায় আমি আমার কল্পনায় স্থান দিয়েছিলাম।যারা শুধুই শিক্ষিকা।তারা ফুচকা খায় না,গল্প করেন না,হাসেন না,কৌতুক করেন না।সব ভুল ভেঙেছিল যখন আমি ওই প্রাইমারি টিচার্স রুমে জয়েন করলাম।আর এখন ভাবলে মজা লাগে সবচেয়ে কাছের অসমবয়সী বন্ধু ছিলেন আমার মন্দিরাদি।যাকে দেখলে ছেলেবেলায় ভয়ে লুকিয়ে পরতাম।
প্রাইমারিতে দুজন নতুন মানুষের অপার স্নেহ আমাকে স্কুল এর প্রতি ভীতি কাটাতে খুব সাহায্য করেছিল।সিস্টার জিতা ও আমার প্রিয় সিস্টার অ্যান্জেলা।সিস্টার জিতা আমাকে খুবই মোটিভেট করতেন।উনি একবার বলেছিলেন , ছোটোবেলায় উনি নাকি ইংরাজিতে একদম ভালো ছিলেন না।কিন্তু উনি আমাদের ইংরাজী পড়াতেন।বলেছিলেন চেষ্টা করলে সব সমস্যার সমাধান হয়।আমি অঙ্কে ভালো না হলেও পরবর্তীকালে আমার ছাত্রছাত্রীরা যখন অঙ্কে ভালো নম্বর পায় ,তখন সিস্টার জিতার কথা মনে পরে।মনে হয় কোথাও যেন আমার চেষ্টা সফল হয়েছে।
শুধু পড়াশুনা নয়,সিস্টারদের নজর ছিল সব দিকেই।একবার আমি টিফিন নিয়ে যেতে ভুলে গেছি।কোনোরকমে সিস্টার সে কথা জানতে পারেন।হয়তো ক্লাসের বন্ধুদের থেকেই।টিফিনের পর হলে প্রার্থনার শেষে দু-তিনজন মেয়ের সাথে আমাকে স্টেজে এসে দাঁড়াতে বলা হলো।আমার লাইন ক্লাসে চলে গেল।দুরুদুরু বক্ষে স্টেজের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।সিস্টার এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখা প্লেটের দিকে নির্দেশ করে বললেন..."খেয়ে নিয়ে ক্লাসে যাও"।প্লেটে রাখা ছিল দুটি করে জ্যাম মাখানো পাউরুটি।খুব সাধারন ঘটনা হয়তো....কিন্তু আমি আজও ভুলিনি।হয়তো সবারই মনে আছে টিফিনের সময় আমাদের দুরকমের খাবার ফেলার জায়গা থাকতো।একটায় খাবারের উচ্ছিষ্ঠ আর অন্যটায় নোংরা,খোসা,প্যাকেট ইত্যাদি।আমাদের টিফিন শেষ হয়ে যাওয়ার পর স্কুলের গেট খুলে দেওয়া হতো।রাস্তায় থাকা ছেলেমেয়েদের জন্য।তারা এসে প্রথম পাত্র থেকে উচ্ছিষ্ঠ খাবারের অংশ তুলে নিত ।তোএকবার আমি টিফিনে মার দেওয়া খাবার অপছন্দ বশত পুরোটাই প্রথম পাত্রে ফেলে দিয়েছি।আমি জানি কেউ জানতে পারবে না।টিফিনের পর লাইন যখন এগোচ্ছে ক্লাসের দিকে হঠাৎ সিস্টার এসে বললেন, "টিফিন খেয়েছো"?সিস্টারের চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলতে পারিনি।কিন্ত স্কুল জীবনে এই রহস্যের সমাধান কোনদিন করতে পারিনি যে সিস্টাররা সব জানতে পারতেন কি করে!!!!
ক্লাস টু।আবার গার্জেন কল্।(নতুন নয়… আমার জীবনে এ ঘটনা লেগেই থাকতো।)এবারের ডাক হেডমিসট্রেসের কাছ থেকে।সিস্টার নাটালিয়া (যার লাল ফ্রেমের চশমা দেখলেই বুক কেঁপে উঠতো) চলে যাওয়ার পর সিস্টার অ্যান্জেলা এলেন ওই পদে।মা আর দিদিভাইর সাথে আমিও ঢুকলাম হেডমিসট্রেসের ঘরে।সিস্টার মাকে দেখেই বললেন,"মিসেস রায়,আমি পরমাকে নিয়ে কি করব?দেখুন কি লিখেছে !!!" Goat দিয়ে বাক্যরচনা করতে দেওয়া হয়েছিল।আমি অনেক মাথা খাটিয়ে লিখেছিলাম I am a goat…..
ক্লাসে নীতাদি He আর Sheর পার্থক্য বোঝানোর সময় একসাথে He আর She উচ্চারণ করলে আমার খালি “হিসি” ভেবেই হাসি পেতো। এরকম ঘটনা লেগেই থাকত।তার সাথে ছিল “too much talkative” এর তকমা।( এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা না বলে পারছি না....তখন আমি আনন্দপালিত হোলিচাইল্ডের শিক্ষিকা।আর সিস্টার অ্যান্জেলা ওই স্কুলের মাদার।আমার ক্লাস কোনো একটা কারনে দুষ্টুমি করার জন্য আমার কাছে যৎপরনাস্তি বকা খাচ্ছে। সিস্টার অ্যান্জেলা রাউন্ডে বেড়িয়েছেন।হঠাৎ আমার ক্লাসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমায় ডেকে বাইরে আসতে বললেন।আমি বাইরে বেড়িয়ে সিস্টারের সামনে যেতেই উনি জানতে চাইলেন আমি কেন বাচ্চাদের বকছি?আমিও দিলাম তাদের দুষ্টুমির ফিরিস্তি।সিস্টার শান্ত হয়ে সব শুনে একটাই কথা বললেন..."তোমার দুষ্টুমির গল্প তোমার ছাত্রীদের একটু শোনাবো নাকি"?বলে আদর করে গালটা একটু টিপে দিয়ে বললেন , "handle with care my child...they are like flowers ")।
Goat এর জীবন এই ভাবেই এগিয়ে যেতে থাকলো।যতদুর মনে পরে তখন আমি ক্লাস টু বা থ্রি আর দিদিভাই সেকেন্ডারী।দিদিভাই এর অসুস্থতার কারনে ওকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল।মাও ছিলেন ওর সাথে।শিশু মনে খুব চাপ পরেছিল সেই সময়টা।এর কিছুদিন পর দিদিভাইকে ট্রিটমেন্টের জন্য মাদ্রাজ নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পরলে, মা শুধু মাত্র দিদিভাই এর ছুটির জন্য আবেদন জানান সিস্টার রোমানার কাছে। সিস্টার অ্যান্জেলা নিজে থেকে মাকে ডেকে আমাকেও সাথে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উনি বলেছিলেন, "পরমা মানসিক ভাবে খুব কষ্টের মধ্যে আছে।মেয়েটা আমার কিছু বলতে পারছে না কাউকে"।যা উনি আমার শৈশবে করেছিলেন তাই উনি আমাকে আমার ক্লাসের শিশুদের জন্য করতে শিখিয়েছিলেন ("handle with care my child...they are like flowers ")।সিস্টারের অনুমতি পেয়ে আমিও প্রায় দিন ১৫-২০ এর জন্য মাদ্রাজ গেলাম (যেখানে স্কুলে একদিনেরও অনুপস্থিতি নিয়ে এবং অনুপস্থিত থাকলে চিঠি জমা দেওয়া নিয়ে যথেষ্ঠ কড়াকড়ি ছিল)।মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসার পর দিদিভাইকে শারিরীক কারন বশত সল্টলেকে বাড়ীর কাছের স্কুলে ভর্তি করা হলো।আমি একা হয়ে পরলাম।আর পড়াশুনার সাথে দূরত্ব যথারিতী বজায় রইল।
আস্তে আস্তে প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে সেকেন্ডারিতে এলাম।ক্লাস V…। ক্লাশ টিচার কণাদি।খুব দিদা দিদা মনে হতো আমার ওনাকে।অদ্ভুত মায়া মাখানো স্বভাব।সেই বছর আমাদের এক নতুন দিদি জয়েন করেছিলেন।যতদুর মনে হয় তার নাম প্রকৃতিদি।কি জানি ভুলও হতে পারে।কি মিষ্টি দেখতে ছিল।বেশি দিনের জন্য থাকেননি উনি।সেকেন্ডারিতে আসার পর নিত্য নতুন দিদিমনিদের আসা এবং চলে যাওয়ার সাথে আমরাও অভ্যস্থ হয়ে উঠছিলাম।
ক্লাস V এর হাফইয়ার্লি পরীক্ষার ঠিক আগেই আমার হাত ভাঙলো।ডাক্তার কাকু বললেন পরীক্ষা দেওয়া তো দুর আমার পক্ষে স্কুল করাই তখন অসম্ভব ব্যাপার।এই প্রথম দেখা হলো তাঁর সাথে।যাঁর উপস্থিতি আমার স্কুল এবং স্কুল পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছিল ব্যাপক ভাবে।সিস্টার রোমানা।আগে দুর থেকে দেখেছি।দিদিভাই এর মুখে অনেক নামও শুনেছি।যিনি এসে দাঁড়ালে সারা স্কুলে পিন পড়লে আওয়াজ শোনা যেত।এমনই ব্যাক্তিত্বময়ী চরিত্র।ভাঙা হাত নিয়ে বাবার সাথে গেলাম সিস্টারের সাথে দেখা করতে।আমার মনে আছে চ্যাপেলের ঠিক পাশে যে সিড়িটা শুধুমাত্র সিস্টারদের ব্যবহারের জন্য রক্ষিত ছিল,সেই সিড়ি দিয়ে সাদা পোশাকে স্মিত হাসি মুখে লাঠি হাতে সিস্টার নামলেন।সিস্টারের তখন পা ভেঙে গিয়েছিল।উনি এসে বসে বাবার সাথে কথা বলছেন।আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেই চলেছি।হাত ভেঙেছে বলে নাকি পরীক্ষা দিতে পারব না বলে (যদিও সেটা কারন হবার সম্ভাবনা খুবই কম)নাকি সিস্টার রোমানার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল সেটা আজ আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, আমার কান্না দেখে সিস্টার আমায়, তারও পা ভেঙে গেছে ,এতে ভয়ের কিছু নেই ...সুস্থ হয়ে উঠব তাড়াতাড়ি ইত্যাদি ভাবে অভয় দিয়ে এবংপরীক্ষায় না বসে বাড়ীতে গিয়ে বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দিলেন।স্কুল জীবনে সিস্টার রোমানার কাছ থেকে যা শুনেছি, যা শিখেছি,তার সব অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি বা ম্যাচুরিটি কোনোটাই আমার ছিলোনা।কিন্তু সিস্টার একটা কথা বলতেন,আজ যার মানে বুঝতে পারছোনা একদিন দেখবে সব বুঝতে পারবে।সত্যি তাই।জীবনের প্রতি পদে তার কথার অর্থ ,আমার জীবনে তার উপস্থিতিকে অনুভব করিয়েছে।
ছোটো ছোটো কত ঘটনা।১৩বছর কম তো নয়।বলতে গেলে শেষ হবে না।কণাদি,লতিকাদি মিনতিদি,,নীলিমাদি,নন্দিনীদি,অন্জলিদি, বন্দনাদি,কল্পনাদি,আল্পনাদি,আরতিদি,নীতাকাদি,জয়ন্তীদি, বড়ো তৃপ্তিদি, ছোটো তৃপ্তিদি, সুচিত্রাদি,কৃষ্ঞাদি,শাশ্বতীদি,শর্মিষঠাদি,তপশ্রীদি (যার সাথে পরবর্তীকালে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো)প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যক্তিত্বে ছোটো বড় নানা ঘটনার মাধ্যমে আমাদের সকলের জীবনেই পৃথক পৃথক ভাবে জায়গা নিয়ে রয়েছেন।এনাদের প্রতি আমাদের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম।আর দিদিরা উজাড় করে দিয়েছিলেন কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে অফুরন্ত ভালোবাসা।
ক্লাস VI এ আমাদের ইংরাজী পড়াতেন নন্দিনীদি।পড়া বলতে না পারলে উনি এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায় “disgusting” বলে বইটা এমন কায়দা করে ছুঁড়ে টেবিলে রাখতেন অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তা রপ্ত করতে পারিনি।বড়ো হওয়ার সাথে সাথে দুষ্টু বুদ্ধি গুলো মাথার মধ্যে অঙ্কুরিত ছোলার মতো বেড়ে উঠতে থাকলো।মিনতিদির পড়ানোর সময় "অ্যাঁ" বলার মুদ্রাদোষ ছিল।ক্লাসে বসে আমরা গুটি কয়েক দুষ্টু গুনতাম দিদি কতবার "অ্যাঁ" বললেন।নিছকই মজা।গুরুজনদের অসম্মান করার কোনো অভিসন্ধিৎসা তার মধ্যে কখনোই ছিল না।ক্লাসের উন্নতির সাথে সাথে বন্ধুপ্রীতি গাঢ় হতে থাকলো। আর পড়াশুনার সাথে সম্পর্ক যেটুকু প্রয়োজন ব্যস সেইটুকু।
ক্লাস VII… এ আমাদের পাজামা বানানো শেখানো হয়েছিল।আমাকে মা কোনোদিনই বাড়ী থেকে সেলাই করে দিতেন না।বলতেন নিজে যা পারো তাই করো।ঠিক সময়ের মধ্যে আমার পাজামা তৈরী হয়ে উঠলো না।দাদার বুদ্ধিতে পাজামার Main Point এ স্টেপেল করে বড়ো কৃষ্ঞাদির কাছে নিয়ে গেলাম।তারপর যা হবার তাই হলো।বুঝে নাও বাকীটা....।কিন্তু এর পরের ঘটনা ছিল মর্মান্তিক।বড়ো কৃষ্ঞাদি আমায় সোনালীর কাছ থেকে পাজামার অঙ্ক শিখে কাটিং শেখার নির্দেশ দিলেন।কারন সোনালীর বানানো পাজামাটা নিখুঁত ছিল।মর্মান্তিক এই কারনে, কারন বড়ো কৃষ্ঞাদি আজও জানেন না, পাজামাটা সোনালী নয় সোনালীর পাড়ার দর্জি বানিয়েছিল।এরকম কতো মজার মজার ঘটনা লিখতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।ক্লাস VII এ চারতলার বারান্দায় আমাদের ক্লাস ছিল।উল্টোদিকে ছিল ভবতরন স্কুল।একবার কি একটা কারনে শাস্তি পেয়েছে।দাঁড়িয়ে আছি দুই হাত ডানা মেলে সবাই।রাস্তার ধারে জানলার দিকের কোনো এক বন্ধুর পাখি হয়ে ডানা ঝাপটানোর শখ হয়েছিল মনে হয়।যা দেখে ভবতরন স্কুলের ছাদে থাকা ছেলেরা অল্প বিস্তর উৎসাহিত হয়ে পরে।কিন্তু যে ডানা ঝাপটেছিল সে পাশের স্কুলের ছেলেদের ইঙ্গিত করেনি সেটা নিশ্চিত।কিন্ত নীচ থেকে কোনো দিদি বা সিস্টার ছেলেদের উৎসাহ দেখতে পান এবং উপরে এসে আমাদের যৎপরনাস্তি বকা খেতে হয় ।কে পাখি হবার চেষ্টা করেছিল কেউ জানলেও সে ব্যাপারে কেউ মুখ খোলেনি।কারন হোলি চাইল্ড আমাদের একসূত্রে বেঁধেছিল।একতাই বলের নীতিকাহিনী আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল।যার জন্য এক সাথে শাস্তি পাওয়াতে লজ্জিত হওয়ার কোনো কারন দেখিনি।বরং এক সাথে শাস্তির মজাই ছিল আলাদা রকমের।
সিস্টার রোমানার প্রতি ভীতি একটু বেশি থাকার দরুন যে সিস্টারের সান্নিধ্য আমি সেই সময় এবং পরবর্তী জীবনে (শিক্ষকতার সময়েও) বিশেষ করে পেয়েছি তিনি সিস্টার লিলিয়ান।যেকোনো অসুবিধা ,আবদার ,অভিযোগ নির্দ্ধিধায় উজার করে মেলে ধরেছি ওনার কাছে।আর উনি তার মীমাংসা করেছেন।হোলি চাইল্ডে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব উনি আমাকে দিয়েছিলেন।যাদের ছাত্রী ছিলাম তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ প্রথম সিস্টার লিলিয়ানের হাত ধরেই আমার পাওয়া।ছোটোবেলা থেকেই আমাদের স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে নীতিশিক্ষার ক্লাসের উপর যথেষ্ঠ জোড় দেওয়া হতো।পরীক্ষাও নেওয়া হতো এই বিষয়ে।সিস্টার রোমানার দেওয়া নীতিশিক্ষার ক্লাস আমাদের জীবনের ক্ষেত্রে কিরূপ প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানি এবং মানিও।এই সময়ে যে সিস্টারকে আমরা ছোটোবেলা থেকেই দেখে এসেছি স্কুলের বারান্দায় কিংবা চ্যাপেলে প্রার্থনারত অবস্থায় তার আবির্ভাব হলো। সিস্টার মনিকা।অসম্ভব ধীর, স্থির,মৃদু এবং অল্পভাষী ছিলেন।ক্লাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্লাসে গোলমাল দেখলে মৃদু ভর্ৎসনা দিয়ে যেতেন।আর সেই ভর্ৎসনার মধ্যে "শয়তান" শব্দটির প্রয়োগ আজও আমরা কেউ ভুলিনি।
পড়াশুনার সাথে ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন, ক্লাসের ফাঁকে তার রিহার্শাল,প্রতিযোগিতা,স্পোর্টস,বছর শেষে এগজিবিশন ও ফুডস্টল।এই শেষ দুটি বিষয়ের জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম।কারন ওই দুদিন আমরা ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ।পড়াশুনা বিহীন আনন্দময় জীবন।ফুড স্টলে লাইন দিয়ে খাবার কেনা, নিজের হাতের তৈরী জিনিষের প্রদর্শনী আর এর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ ছিল ওই দুদিন হোলি চাইল্ডে ছেলেদের(বন্ধুর বয়ফ্রেন্ড,বন্ধুর দাদাদের)অবাধ প্রবেশ।কিন্তু এসবই হতো সিস্টার ও দিদিদের নজরদারিতে (যেটা আমরা তখন বুঝতাম না)।
আজ বলতে লজ্জা নেই, আমার জীবনের প্রথম মোড় ঘোরার গল্প।ক্লাস VIII…..।আমার জন্য যা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।আনন্দ,মজা,গালগপ্প,বন্ধুপ্রীতি করে যে শুধু জীবন চলে না তার শিক্ষা।বছর শেষে অ্যানুয়াল পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড হাতে পেলাম না।গার্জেন সমেত হেড মিস্ট্রেসের ঘরে দেখা করার নির্দেশ এল।বাবা মার সাথে দুপুরে সিস্টার রোমানার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।আমার মতো আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন।যখন ডাক পরল বাবা মার সাথে সিস্টারের ঘরে ঢুকলাম।সিস্টার রোমানার ওই রূপ আমি একদিনই দেখেছিলাম।ক্লাস VIII এর সব সাবজেক্ট এর দিদিরা,সিস্টার লিলিয়ান, আমার বাবা মার সামনে সিস্টার রোমানা আমায় অনেক কথা বলেছিলেন।যার কোনো কথা আজ আর আমার মনে নেই।শুধু একটা বাক্য আমি আজও ভুলিনি যা উনি আমার বাবাকে বলেছিলেন। “Mr.Roy…… যেদিন আপনি আপনার বড়ো মেয়ের অসুস্থতার কারনে সর্বানীকে (আমার দিদিভাই) নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এই স্কুল থেকে আমি রাজী হইনি তখন,কিন্তু আজ আমি চাই আপনি নিয়ে যান পরমাকে অন্য কোথাও।আমার দরকার নেই পরমাকে"।এই একটা বাক্য আমাকে নিজেকে সামলানোর জন্য যথেষ্ঠ ছিল।পরমা আর পড়াশুনার মধ্যে যোগাযোগ ঘটলো সেইদিন প্রথম।পরে হোলি চাইল্ডে শিক্ষকতার সময় একবার সিস্টার রোমানা যখন এসেছিলেন আমি জানতে চেয়েছিলাম উনি সত্যি চেয়েছিলেন কিনা আমি স্কুল থেকে চলে যাই। উনি হেসে বলেছিলেন,"আমি জানতাম তুমি পারবে,তাই ওই ধাক্কাটা তোমার দরকার ছিলো।তুমি নিজেই দেখো তুমি পেরেছো কিনা।তোমার রেজাল্ট গুলোই তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবে"।পরে ভেবে দেখেছিলাম.... সত্যি তাই।
ক্লাস IX….।সিস্টার রোমানা
শুধুমাত্র বকুনি দিয়েই ছেড়ে দেননি।ক্লাসে সবাই যখন কে কি Additional Subject
নেবে ঠিক করছে ,সিস্টার ডেকে পাঠালেন আমাকে এবং পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন তুমি
কোনো Additional Subject নেবে না।তুমি Additional
Subject ছাড়াই মাধ্যমিক দেবে। সে বছর আমি ছাড়া সবাই Additional Subject নিয়েছিলো
।আর আমিও সিস্টারের কথা মতো পড়াশুনায় মন দিলাম।এবং
Additional Subject ছাড়াই 1st divison পেলাম। নিজের আত্মবিশ্বাস,অধ্যাবশায়ের যে কোনো বিকল্প নেই
তা এই মানুষটির হাত ধরেই শেখা।আমার ছেলেবেলায় আমার শিক্ষিকাদের একটা অন্য জায়গায় আমি আমার কল্পনায় স্থান দিয়েছিলাম।যারা শুধুই শিক্ষিকা।তারা ফুচকা খায় না,গল্প করেন না,হাসেন না,কৌতুক করেন না।সব ভুল ভেঙেছিল যখন আমি ওই প্রাইমারি টিচার্স রুমে জয়েন করলাম।আর এখন ভাবলে মজা লাগে সবচেয়ে কাছের অসমবয়সী বন্ধু ছিলেন আমার মন্দিরাদি।যাকে দেখলে ছেলেবেলায় ভয়ে লুকিয়ে পরতাম।
প্রাইমারিতে দুজন নতুন মানুষের অপার স্নেহ আমাকে স্কুল এর প্রতি ভীতি কাটাতে খুব সাহায্য করেছিল।সিস্টার জিতা ও আমার প্রিয় সিস্টার অ্যান্জেলা।সিস্টার জিতা আমাকে খুবই মোটিভেট করতেন।উনি একবার বলেছিলেন , ছোটোবেলায় উনি নাকি ইংরাজিতে একদম ভালো ছিলেন না।কিন্তু উনি আমাদের ইংরাজী পড়াতেন।বলেছিলেন চেষ্টা করলে সব সমস্যার সমাধান হয়।আমি অঙ্কে ভালো না হলেও পরবর্তীকালে আমার ছাত্রছাত্রীরা যখন অঙ্কে ভালো নম্বর পায় ,তখন সিস্টার জিতার কথা মনে পরে।মনে হয় কোথাও যেন আমার চেষ্টা সফল হয়েছে।
শুধু পড়াশুনা নয়,সিস্টারদের নজর ছিল সব দিকেই।একবার আমি টিফিন নিয়ে যেতে ভুলে গেছি।কোনোরকমে সিস্টার সে কথা জানতে পারেন।হয়তো ক্লাসের বন্ধুদের থেকেই।টিফিনের পর হলে প্রার্থনার শেষে দু-তিনজন মেয়ের সাথে আমাকে স্টেজে এসে দাঁড়াতে বলা হলো।আমার লাইন ক্লাসে চলে গেল।দুরুদুরু বক্ষে স্টেজের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।সিস্টার এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখা প্লেটের দিকে নির্দেশ করে বললেন..."খেয়ে নিয়ে ক্লাসে যাও"।প্লেটে রাখা ছিল দুটি করে জ্যাম মাখানো পাউরুটি।খুব সাধারন ঘটনা হয়তো....কিন্তু আমি আজও ভুলিনি।হয়তো সবারই মনে আছে টিফিনের সময় আমাদের দুরকমের খাবার ফেলার জায়গা থাকতো।একটায় খাবারের উচ্ছিষ্ঠ আর অন্যটায় নোংরা,খোসা,প্যাকেট ইত্যাদি।আমাদের টিফিন শেষ হয়ে যাওয়ার পর স্কুলের গেট খুলে দেওয়া হতো।রাস্তায় থাকা ছেলেমেয়েদের জন্য।তারা এসে প্রথম পাত্র থেকে উচ্ছিষ্ঠ খাবারের অংশ তুলে নিত ।তোএকবার আমি টিফিনে মার দেওয়া খাবার অপছন্দ বশত পুরোটাই প্রথম পাত্রে ফেলে দিয়েছি।আমি জানি কেউ জানতে পারবে না।টিফিনের পর লাইন যখন এগোচ্ছে ক্লাসের দিকে হঠাৎ সিস্টার এসে বললেন, "টিফিন খেয়েছো"?সিস্টারের চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলতে পারিনি।কিন্ত স্কুল জীবনে এই রহস্যের সমাধান কোনদিন করতে পারিনি যে সিস্টাররা সব জানতে পারতেন কি করে!!!!
ক্লাস টু।আবার গার্জেন কল্।(নতুন নয়… আমার জীবনে এ ঘটনা লেগেই থাকতো।)এবারের ডাক হেডমিসট্রেসের কাছ থেকে।সিস্টার নাটালিয়া (যার লাল ফ্রেমের চশমা দেখলেই বুক কেঁপে উঠতো) চলে যাওয়ার পর সিস্টার অ্যান্জেলা এলেন ওই পদে।মা আর দিদিভাইর সাথে আমিও ঢুকলাম হেডমিসট্রেসের ঘরে।সিস্টার মাকে দেখেই বললেন,"মিসেস রায়,আমি পরমাকে নিয়ে কি করব?দেখুন কি লিখেছে !!!" Goat দিয়ে বাক্যরচনা করতে দেওয়া হয়েছিল।আমি অনেক মাথা খাটিয়ে লিখেছিলাম I am a goat…..
ক্লাসে নীতাদি He আর Sheর পার্থক্য বোঝানোর সময় একসাথে He আর She উচ্চারণ করলে আমার খালি “হিসি” ভেবেই হাসি পেতো। এরকম ঘটনা লেগেই থাকত।তার সাথে ছিল “too much talkative” এর তকমা।( এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা না বলে পারছি না....তখন আমি আনন্দপালিত হোলিচাইল্ডের শিক্ষিকা।আর সিস্টার অ্যান্জেলা ওই স্কুলের মাদার।আমার ক্লাস কোনো একটা কারনে দুষ্টুমি করার জন্য আমার কাছে যৎপরনাস্তি বকা খাচ্ছে। সিস্টার অ্যান্জেলা রাউন্ডে বেড়িয়েছেন।হঠাৎ আমার ক্লাসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমায় ডেকে বাইরে আসতে বললেন।আমি বাইরে বেড়িয়ে সিস্টারের সামনে যেতেই উনি জানতে চাইলেন আমি কেন বাচ্চাদের বকছি?আমিও দিলাম তাদের দুষ্টুমির ফিরিস্তি।সিস্টার শান্ত হয়ে সব শুনে একটাই কথা বললেন..."তোমার দুষ্টুমির গল্প তোমার ছাত্রীদের একটু শোনাবো নাকি"?বলে আদর করে গালটা একটু টিপে দিয়ে বললেন , "handle with care my child...they are like flowers ")।
Goat এর জীবন এই ভাবেই এগিয়ে যেতে থাকলো।যতদুর মনে পরে তখন আমি ক্লাস টু বা থ্রি আর দিদিভাই সেকেন্ডারী।দিদিভাই এর অসুস্থতার কারনে ওকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল।মাও ছিলেন ওর সাথে।শিশু মনে খুব চাপ পরেছিল সেই সময়টা।এর কিছুদিন পর দিদিভাইকে ট্রিটমেন্টের জন্য মাদ্রাজ নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পরলে, মা শুধু মাত্র দিদিভাই এর ছুটির জন্য আবেদন জানান সিস্টার রোমানার কাছে। সিস্টার অ্যান্জেলা নিজে থেকে মাকে ডেকে আমাকেও সাথে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উনি বলেছিলেন, "পরমা মানসিক ভাবে খুব কষ্টের মধ্যে আছে।মেয়েটা আমার কিছু বলতে পারছে না কাউকে"।যা উনি আমার শৈশবে করেছিলেন তাই উনি আমাকে আমার ক্লাসের শিশুদের জন্য করতে শিখিয়েছিলেন ("handle with care my child...they are like flowers ")।সিস্টারের অনুমতি পেয়ে আমিও প্রায় দিন ১৫-২০ এর জন্য মাদ্রাজ গেলাম (যেখানে স্কুলে একদিনেরও অনুপস্থিতি নিয়ে এবং অনুপস্থিত থাকলে চিঠি জমা দেওয়া নিয়ে যথেষ্ঠ কড়াকড়ি ছিল)।মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসার পর দিদিভাইকে শারিরীক কারন বশত সল্টলেকে বাড়ীর কাছের স্কুলে ভর্তি করা হলো।আমি একা হয়ে পরলাম।আর পড়াশুনার সাথে দূরত্ব যথারিতী বজায় রইল।
আস্তে আস্তে প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে সেকেন্ডারিতে এলাম।ক্লাস V…। ক্লাশ টিচার কণাদি।খুব দিদা দিদা মনে হতো আমার ওনাকে।অদ্ভুত মায়া মাখানো স্বভাব।সেই বছর আমাদের এক নতুন দিদি জয়েন করেছিলেন।যতদুর মনে হয় তার নাম প্রকৃতিদি।কি জানি ভুলও হতে পারে।কি মিষ্টি দেখতে ছিল।বেশি দিনের জন্য থাকেননি উনি।সেকেন্ডারিতে আসার পর নিত্য নতুন দিদিমনিদের আসা এবং চলে যাওয়ার সাথে আমরাও অভ্যস্থ হয়ে উঠছিলাম।
ক্লাস V এর হাফইয়ার্লি পরীক্ষার ঠিক আগেই আমার হাত ভাঙলো।ডাক্তার কাকু বললেন পরীক্ষা দেওয়া তো দুর আমার পক্ষে স্কুল করাই তখন অসম্ভব ব্যাপার।এই প্রথম দেখা হলো তাঁর সাথে।যাঁর উপস্থিতি আমার স্কুল এবং স্কুল পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছিল ব্যাপক ভাবে।সিস্টার রোমানা।আগে দুর থেকে দেখেছি।দিদিভাই এর মুখে অনেক নামও শুনেছি।যিনি এসে দাঁড়ালে সারা স্কুলে পিন পড়লে আওয়াজ শোনা যেত।এমনই ব্যাক্তিত্বময়ী চরিত্র।ভাঙা হাত নিয়ে বাবার সাথে গেলাম সিস্টারের সাথে দেখা করতে।আমার মনে আছে চ্যাপেলের ঠিক পাশে যে সিড়িটা শুধুমাত্র সিস্টারদের ব্যবহারের জন্য রক্ষিত ছিল,সেই সিড়ি দিয়ে সাদা পোশাকে স্মিত হাসি মুখে লাঠি হাতে সিস্টার নামলেন।সিস্টারের তখন পা ভেঙে গিয়েছিল।উনি এসে বসে বাবার সাথে কথা বলছেন।আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেই চলেছি।হাত ভেঙেছে বলে নাকি পরীক্ষা দিতে পারব না বলে (যদিও সেটা কারন হবার সম্ভাবনা খুবই কম)নাকি সিস্টার রোমানার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল সেটা আজ আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, আমার কান্না দেখে সিস্টার আমায়, তারও পা ভেঙে গেছে ,এতে ভয়ের কিছু নেই ...সুস্থ হয়ে উঠব তাড়াতাড়ি ইত্যাদি ভাবে অভয় দিয়ে এবংপরীক্ষায় না বসে বাড়ীতে গিয়ে বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দিলেন।স্কুল জীবনে সিস্টার রোমানার কাছ থেকে যা শুনেছি, যা শিখেছি,তার সব অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি বা ম্যাচুরিটি কোনোটাই আমার ছিলোনা।কিন্তু সিস্টার একটা কথা বলতেন,আজ যার মানে বুঝতে পারছোনা একদিন দেখবে সব বুঝতে পারবে।সত্যি তাই।জীবনের প্রতি পদে তার কথার অর্থ ,আমার জীবনে তার উপস্থিতিকে অনুভব করিয়েছে।
ছোটো ছোটো কত ঘটনা।১৩বছর কম তো নয়।বলতে গেলে শেষ হবে না।কণাদি,লতিকাদি মিনতিদি,,নীলিমাদি,নন্দিনীদি,অন্জলিদি, বন্দনাদি,কল্পনাদি,আল্পনাদি,আরতিদি,নীতাকাদি,জয়ন্তীদি, বড়ো তৃপ্তিদি, ছোটো তৃপ্তিদি, সুচিত্রাদি,কৃষ্ঞাদি,শাশ্বতীদি,শর্মিষঠাদি,তপশ্রীদি (যার সাথে পরবর্তীকালে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো)প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যক্তিত্বে ছোটো বড় নানা ঘটনার মাধ্যমে আমাদের সকলের জীবনেই পৃথক পৃথক ভাবে জায়গা নিয়ে রয়েছেন।এনাদের প্রতি আমাদের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম।আর দিদিরা উজাড় করে দিয়েছিলেন কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে অফুরন্ত ভালোবাসা।
ক্লাস VI এ আমাদের ইংরাজী পড়াতেন নন্দিনীদি।পড়া বলতে না পারলে উনি এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায় “disgusting” বলে বইটা এমন কায়দা করে ছুঁড়ে টেবিলে রাখতেন অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তা রপ্ত করতে পারিনি।বড়ো হওয়ার সাথে সাথে দুষ্টু বুদ্ধি গুলো মাথার মধ্যে অঙ্কুরিত ছোলার মতো বেড়ে উঠতে থাকলো।মিনতিদির পড়ানোর সময় "অ্যাঁ" বলার মুদ্রাদোষ ছিল।ক্লাসে বসে আমরা গুটি কয়েক দুষ্টু গুনতাম দিদি কতবার "অ্যাঁ" বললেন।নিছকই মজা।গুরুজনদের অসম্মান করার কোনো অভিসন্ধিৎসা তার মধ্যে কখনোই ছিল না।ক্লাসের উন্নতির সাথে সাথে বন্ধুপ্রীতি গাঢ় হতে থাকলো। আর পড়াশুনার সাথে সম্পর্ক যেটুকু প্রয়োজন ব্যস সেইটুকু।
ক্লাস VII… এ আমাদের পাজামা বানানো শেখানো হয়েছিল।আমাকে মা কোনোদিনই বাড়ী থেকে সেলাই করে দিতেন না।বলতেন নিজে যা পারো তাই করো।ঠিক সময়ের মধ্যে আমার পাজামা তৈরী হয়ে উঠলো না।দাদার বুদ্ধিতে পাজামার Main Point এ স্টেপেল করে বড়ো কৃষ্ঞাদির কাছে নিয়ে গেলাম।তারপর যা হবার তাই হলো।বুঝে নাও বাকীটা....।কিন্তু এর পরের ঘটনা ছিল মর্মান্তিক।বড়ো কৃষ্ঞাদি আমায় সোনালীর কাছ থেকে পাজামার অঙ্ক শিখে কাটিং শেখার নির্দেশ দিলেন।কারন সোনালীর বানানো পাজামাটা নিখুঁত ছিল।মর্মান্তিক এই কারনে, কারন বড়ো কৃষ্ঞাদি আজও জানেন না, পাজামাটা সোনালী নয় সোনালীর পাড়ার দর্জি বানিয়েছিল।এরকম কতো মজার মজার ঘটনা লিখতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।ক্লাস VII এ চারতলার বারান্দায় আমাদের ক্লাস ছিল।উল্টোদিকে ছিল ভবতরন স্কুল।একবার কি একটা কারনে শাস্তি পেয়েছে।দাঁড়িয়ে আছি দুই হাত ডানা মেলে সবাই।রাস্তার ধারে জানলার দিকের কোনো এক বন্ধুর পাখি হয়ে ডানা ঝাপটানোর শখ হয়েছিল মনে হয়।যা দেখে ভবতরন স্কুলের ছাদে থাকা ছেলেরা অল্প বিস্তর উৎসাহিত হয়ে পরে।কিন্তু যে ডানা ঝাপটেছিল সে পাশের স্কুলের ছেলেদের ইঙ্গিত করেনি সেটা নিশ্চিত।কিন্ত নীচ থেকে কোনো দিদি বা সিস্টার ছেলেদের উৎসাহ দেখতে পান এবং উপরে এসে আমাদের যৎপরনাস্তি বকা খেতে হয় ।কে পাখি হবার চেষ্টা করেছিল কেউ জানলেও সে ব্যাপারে কেউ মুখ খোলেনি।কারন হোলি চাইল্ড আমাদের একসূত্রে বেঁধেছিল।একতাই বলের নীতিকাহিনী আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল।যার জন্য এক সাথে শাস্তি পাওয়াতে লজ্জিত হওয়ার কোনো কারন দেখিনি।বরং এক সাথে শাস্তির মজাই ছিল আলাদা রকমের।
সিস্টার রোমানার প্রতি ভীতি একটু বেশি থাকার দরুন যে সিস্টারের সান্নিধ্য আমি সেই সময় এবং পরবর্তী জীবনে (শিক্ষকতার সময়েও) বিশেষ করে পেয়েছি তিনি সিস্টার লিলিয়ান।যেকোনো অসুবিধা ,আবদার ,অভিযোগ নির্দ্ধিধায় উজার করে মেলে ধরেছি ওনার কাছে।আর উনি তার মীমাংসা করেছেন।হোলি চাইল্ডে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব উনি আমাকে দিয়েছিলেন।যাদের ছাত্রী ছিলাম তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ প্রথম সিস্টার লিলিয়ানের হাত ধরেই আমার পাওয়া।ছোটোবেলা থেকেই আমাদের স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে নীতিশিক্ষার ক্লাসের উপর যথেষ্ঠ জোড় দেওয়া হতো।পরীক্ষাও নেওয়া হতো এই বিষয়ে।সিস্টার রোমানার দেওয়া নীতিশিক্ষার ক্লাস আমাদের জীবনের ক্ষেত্রে কিরূপ প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানি এবং মানিও।এই সময়ে যে সিস্টারকে আমরা ছোটোবেলা থেকেই দেখে এসেছি স্কুলের বারান্দায় কিংবা চ্যাপেলে প্রার্থনারত অবস্থায় তার আবির্ভাব হলো। সিস্টার মনিকা।অসম্ভব ধীর, স্থির,মৃদু এবং অল্পভাষী ছিলেন।ক্লাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্লাসে গোলমাল দেখলে মৃদু ভর্ৎসনা দিয়ে যেতেন।আর সেই ভর্ৎসনার মধ্যে "শয়তান" শব্দটির প্রয়োগ আজও আমরা কেউ ভুলিনি।
পড়াশুনার সাথে ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন, ক্লাসের ফাঁকে তার রিহার্শাল,প্রতিযোগিতা,স্পোর্টস,বছর শেষে এগজিবিশন ও ফুডস্টল।এই শেষ দুটি বিষয়ের জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম।কারন ওই দুদিন আমরা ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ।পড়াশুনা বিহীন আনন্দময় জীবন।ফুড স্টলে লাইন দিয়ে খাবার কেনা, নিজের হাতের তৈরী জিনিষের প্রদর্শনী আর এর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ ছিল ওই দুদিন হোলি চাইল্ডে ছেলেদের(বন্ধুর বয়ফ্রেন্ড,বন্ধুর দাদাদের)অবাধ প্রবেশ।কিন্তু এসবই হতো সিস্টার ও দিদিদের নজরদারিতে (যেটা আমরা তখন বুঝতাম না)।
আজ বলতে লজ্জা নেই, আমার জীবনের প্রথম মোড় ঘোরার গল্প।ক্লাস VIII…..।আমার জন্য যা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।আনন্দ,মজা,গালগপ্প,বন্ধুপ্রীতি করে যে শুধু জীবন চলে না তার শিক্ষা।বছর শেষে অ্যানুয়াল পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড হাতে পেলাম না।গার্জেন সমেত হেড মিস্ট্রেসের ঘরে দেখা করার নির্দেশ এল।বাবা মার সাথে দুপুরে সিস্টার রোমানার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।আমার মতো আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন।যখন ডাক পরল বাবা মার সাথে সিস্টারের ঘরে ঢুকলাম।সিস্টার রোমানার ওই রূপ আমি একদিনই দেখেছিলাম।ক্লাস VIII এর সব সাবজেক্ট এর দিদিরা,সিস্টার লিলিয়ান, আমার বাবা মার সামনে সিস্টার রোমানা আমায় অনেক কথা বলেছিলেন।যার কোনো কথা আজ আর আমার মনে নেই।শুধু একটা বাক্য আমি আজও ভুলিনি যা উনি আমার বাবাকে বলেছিলেন। “Mr.Roy…… যেদিন আপনি আপনার বড়ো মেয়ের অসুস্থতার কারনে সর্বানীকে (আমার দিদিভাই) নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এই স্কুল থেকে আমি রাজী হইনি তখন,কিন্তু আজ আমি চাই আপনি নিয়ে যান পরমাকে অন্য কোথাও।আমার দরকার নেই পরমাকে"।এই একটা বাক্য আমাকে নিজেকে সামলানোর জন্য যথেষ্ঠ ছিল।পরমা আর পড়াশুনার মধ্যে যোগাযোগ ঘটলো সেইদিন প্রথম।পরে হোলি চাইল্ডে শিক্ষকতার সময় একবার সিস্টার রোমানা যখন এসেছিলেন আমি জানতে চেয়েছিলাম উনি সত্যি চেয়েছিলেন কিনা আমি স্কুল থেকে চলে যাই। উনি হেসে বলেছিলেন,"আমি জানতাম তুমি পারবে,তাই ওই ধাক্কাটা তোমার দরকার ছিলো।তুমি নিজেই দেখো তুমি পেরেছো কিনা।তোমার রেজাল্ট গুলোই তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবে"।পরে ভেবে দেখেছিলাম.... সত্যি তাই।
এদিকে সিস্টার রোমানার বকুনি খাওয়ার পর বাড়ীতে ফতোয়া জারী হলো।শুধুই পড়াশুনা.....অন্য কিছু স্বপ্নেও ভাববে না।কিন্তু স্কুলে সামনে তখন নাটক প্রতিযোগিতার নাম নির্বাচন চলছে।দেবিকাদি বিনয়-বাদল-দীনেশ নাটকের জন্য আমাকেও নির্বাচন করেছেন।আমার তো তখন ছেড়ে দে মা অবস্থা।দেবিকাদিকে জানালাম,বাবার নিষেধ আছে।পরের দিনই সিস্টার রোমানা ডাকলেন, কেন নাটক করতে চাইছি না জানার জন্য।সব শুনে বললেন Mr.Roy কে কাল একবার দেখা করতে বলো। বাড়ী এসে বাবাকে জানালাম সিস্টার ডেকেছেন।বাবা বিরক্ত হয়ে কারন জানতে চাইলেন।কারন শুনেই দেখলাম বাবা প্রায় ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে বললেন..."আহা! আমি কি নাটক করতে বারন করেছি নাকি?সিস্টার যখন বলেছেন , নিশ্চয়ই করবে।বুঝলাম সিস্টারের কাছে যাওয়ার থেকে মেয়েকে নাটক করতে অনুমতি দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ বলেই বাবা মনে করেছিলেন।আর সিস্টারও হুট করে ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া পড়াশুনার সাথে পড়াশুনার প্রতি ভালোবাসাহীন মেয়েটার মধ্যে একটা মানসিক সামন্জস্য রাখতে চেয়েছিলেন।
এই সময় অভিভাবক ও স্কুলের মধ্যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী হলো।স্কুলের বাইরে দেওয়ালে নোংরা পোস্টার পরল।খবরের কাগজে স্কুলের নামে বিরূপ লেখালেখি হলো।আমরা এককাট্টা হয়ে লড়েছিলাম তার বিরুদ্ধে।স্কুলের এই রকম পরিস্থিতিতে প্রথমবার বোধহয় হেড মিস্ট্রেস বিহীন এক্সকারশনে গেলো আমাদের ক্লাস।বাবা, মা ছাড়া বন্ধুদের সাথেএক রাতের জন্য বেড়াতে যাওয়ার মজাই আলাদা। কেউ কেউ আগের দিন স্কুলেই থেকে গিয়েছিল,আবার আমরা কেউ স্কুলের কাছে বন্ধুর বাড়ীতে থেকে ছিলাম।বন্দনাদি,জয়ন্তীদি,সুচিত্রাদি ও তার মেয়ে এবং ছোটো তৃপ্তিদির মেয়ে জয়শ্রীদি ছিলেন আমাদের সাথে ।কুন্ডু স্পেশালের বাস দেরি করে আসায় আমরা ছড়া বেঁধেছিলাম।
কুণ্ডু তোমার মুন্ডু চাই…../একটা নয় দুটো চাই...../এ বাসের চাই ,ও বাসের চাই…/কুণ্ডু তোমার মুন্ডু চাই……এই জাতীয় কিছু একটা হবে,সঠিক মনে পড়ছে না।দু বাস বোঝাই মেয়ে গিয়েছিলাম ঘাটশিলায়।বাসের মজা, ঘাটশিলার মজা সবই আমাদের জানা।ফিরে আসার পর বেশি উচ্ছ্বলতার জন্য অল্প বিস্তর প্রাপ্য বকুনি সবই ছিলো রোমাঞ্চকর।
এরপরই এলো সিস্টার রোমানার দিল্লী চলে যাবার খবর।সত্যি ভেঙে পরেছিলাম মানসিক ভাবে।কিশোরী মনে প্রিয়জনের বিচ্ছেদ খুবই পীড়াদায়ক ছিল।সিস্টার যতক্ষন সাথে ছিলেন তখন বুঝিনি।কিন্ত হাওড়া স্টেশনে দিল্লীগামী ট্রেনটা ছেড়ে দিলে সারা স্টেশনের লোক দেখছে কিছু কিশোরীর চোখের জল বাঁধ মানছে না। আর “Good Morning Students” কথাটা সিস্টারের মুখ থেকে অ্যাসেমব্লীতে শুনতে পাবো না সত্যি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে চলল।মাধ্যমিক দিলাম ৯৩ ব্যাচ।স্কুল জীবনের সমাপ্তি ঘটলো।ছাড়াছাড়ি হলো প্রাণের বন্ধুদের সাথে। কারো কারো সাথে যোগাযোগ থাকলেও বেশির ভাগই বিচ্ছিন্ন হয়ে পরলাম।আজ সেই মাধ্যমিক দেবার ২৫ বছর পূর্ণ হলো।সাদা জামা ,নীল স্কার্ট,মাথায় বাঁধা সাদা ফিতে একদল কিশোরীর কোলাহল এখনো মনে পরে।সেই বাঁধন আজও আছে,হৃদয়ের আনাচে কানাচে।এখনও যখন এক হই আমাদের পোশাকটাই শুধু বদলায়,কোলাহলটা একইরকম থেকে গেছে।খুঁজে পাইনি যাদের,আর হারিয়ে গেলো যারা তাদের জন্য মন কেমন করে। এই মন কেমন করার ভিতটাই তৈরী করেছে হোলিচাইল্ড ইনস্টিটিউট।
জানি লেখাটা অনেক বড়ো হয়ে গেলো।কি করব বল? হোলি চাইল্ডের স্মৃতি যে অনেক। দিদিদের স্নেহ,সিস্টারদের ভালোবাসা,বন্ধুদের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলা,টিফিনের সময় নির্দ্ধিধায় একে অপরের টিফিন খেয়ে নেওয়া,স্কুলের বাইরে বসা হজমীওয়ালার চম্পা........বলে ডাক,টিফিনের সময় স্কুলের ভিতরে বসা বয়স্ক মহিলার ডেকচি করে আনা আলুকাবলি....শালপাতায় মোড়া কাটলেট,আর সেই নাম না জানা ছেলেটার আমায় স্কুল বাসের জানলা থেকে একবার দেখতে চাওয়া আকুতি ভরা চোখের গল্প না হয় আমার মধ্যেই থাক। যা শুধু আমি জানব আর জানবে সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা ॥
No comments:
Post a Comment